ক্যান্টিন বয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ
রিপোর্ট:-দৈনিক বাংলার মুক্তকন্ঠ! একাত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের'ক্যান্টিন বয়'ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো.মাজেদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে যাবেন এমন কোনো চিন্তাও ছিল না তার। বরং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম (শাহ মখদুম) হলের প্রভোস্টের বাড়িতে ফুটফরমাশসহ রান্নার কাজ শুরু করেন। অথচ সেই তিনিই একাত্তরের ১৩ এপ্রিল রাজশাহীর বিনোদপুর বাজারে পাকিস্তানিদের নারী ধর্ষণের নৃশংস ঘটনা দেখার পর রাগে-ক্ষোভে মুক্তিযুদ্ধে যান। দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গুলি মাজেদুর রহমানের পেটের ডান দিকে বিদ্ধ হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে গ্রেনেডের স্পিল্গন্টার ও বেয়নেটের অনেক ক্ষতচিহ্ন। স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা বলতে গিয়ে মাজেদ সমকালকে বলেন,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি গ্রাস করেছে। উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সরকারের চলমান অভিযান আরও জোরালো করা প্রয়োজন। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশই পারে মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে। এটি করা হলে মুক্তি যোদ্ধাদের রক্তক্ষয় সার্থক হবে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো.মাজেদুর রহমানের বাড়ি পাবনার সুজানগর উপজেলার মোমিন পাড়ার মানিকহাট গ্রামে। ১৯৫১ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি ওই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত জিন্দার আলী মোল্লা কৃষক এবং মা প্রয়াত আমিরুন নেছা ছিলেন গৃহিণী। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাজেদ সবার ছোট। একাত্তরে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গুলি তার পেটের ডান দিকে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেডের স্পিল্গন্টার বিদ্ধ হয়। এ ছাড়াও পাকিস্তানিরা তাকে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষতবিক্ষত করে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাজেদুর রহমান বলেন,একাত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লতিফ হলে ক্যান্টিনবয় হিসেবে কাজ করতাম। পাশেই ছিল কলেজিয়েট স্কুল। তাই লতিফ হলে থেকে কাজের পাশাপাশি ক্লাস করতেও সুবিধে হতো। ২৫ মার্চ ঘুম থেকে উঠে দেখি হলের কলাপসিবল গেট লাগানো। বাইরে যাওয়া যায় না। শুনলাম পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্পাসে এসেছে,কয়েকটি হলে গোলাগুলি হয়েছে। মানুষও মারা গেছে। দুপুরের পর থেকে ক্যাম্পাসের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। আমিও তখন হল থেকে বের হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিই। পরে কয়েকজন ছাত্র আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের তৎকালীন প্রভোস্ট মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি তখন প্রভোস্টের বাড়িতে থেকে ফুটফরমাশ (কাজকর্ম)করতাম।ইপিআর সদস্যরা বাড়িতে এলে তাদের রান্না করেও খাইয়েছি। কয়েকদিন পর প্রভোস্ট আমাকেসহ কয়েক জনকে বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে পরিবারসহ জয়পুরহাট চলে যান। ওখানে থেকেই তখন যুদ্ধের খবরাখবর শুনতাম। তেমনি একদিন রাজশাহীর বিনোদপুর বাজারে গিয়ে যে ঘটনা দেখালাম,তারপর যুদ্ধে না যাওয়ার আর কোনো কারণ ছিল না। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে মাজেদুর রহমান বলেন,দিনটি ছিল একাত্তরের ১৩ এপ্রিল। বিকেলের দিকে বিনোদপুর বাজারে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে বিনোদ পুরেই সন্ধ্যার আগে আগে একটু দূরে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়ে যাই। দেখলাম একটি হিন্দুবাড়ি থেকে একজন ২০-২৫ বছরের মেয়ে কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির সামনেই ছিল পাকিস্তানিদের গাড়ি। তখন গাড়ি থেকে নেমে এক জন পাকিস্তানি সেনা মেয়েটির পিছু নেয়। দৌড়ে ওই পাকিস্তানি সেনা মেয়েটির কাছ থেকে কোলের বাচ্চাটি কেড়ে নেয় এবং শিশুটির পা ঘুরিয়ে ছুড়ে মারে। আরেকজন পাকিস্তানি মেয়েটিকে ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যায়। বাচ্চাটি হয়তো সেখানেই মারা গেছে। তখন এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে,ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আর সাহস হলো না। মেয়েটির জন্য কিছু করতে না পারায় মনে দুঃখ ছিল। রাগও হয়েছিল। কিন্তু একার কিছুই করার ছিল না। সেখান থেকেই পদ্মা নদী পার হয়ে পরদিন চলে যাই ভারতের কেচুয়াডাঙ্গাপাড়ায়। সেখানে স্থানীয় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সঙ্গেই পরে ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দিই। আর সেখান থেকেই শুরু হয় মুক্তি যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মাজেদুর রহমানকে কেচুয়াডাঙ্গা থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের পানিঘটায়। সেখানে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ চলে। ভারতীয় বাহিনীর কর্নেল মোহাম্মদ আলীসহ অনেকেই তাদের ২১ দিন ওই প্রশিক্ষণ দেন। এরপর মাজেদুর রহমানসহ একটি গ্রুপ দেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট,সোনামসজিদ,রহনপুর,কলা বাড়িয়া,পাবনার সাঁথিয়ায় পৃথক অপারেশন করেন। এটি ছিল ৭ নম্বর সেক্টরে। লে.কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ছিলেন কমান্ডার। মাজেদুর ওই সেক্টরে লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর অধীনে যুক্ত হন। তার গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আকতারুজ্জামান। নভেম্বরের শেষ দিকে সাব-সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে আকতারুজ্জামানের নেতৃত্বে মাজেদসহ কয়েকটি পৃথক গ্রুপ পাবনার সাঁথিয়া থানার ধূলাউড়ি গ্রামের হাইস্কুলের পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। ওই অপারেশনেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আহত হন মাজেদুর রহমান। এ প্রসঙ্গে মাজেদুর রহমান বলেন,দিনটি ছিল ২৭ নভেম্বর। সিদ্ধান্ত ছিল কয়েকটি গ্রুপ একযোগে রাত ৩টায় ধুলাউড়ি হাইস্কুলে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করব। আমরা কয়েকটি গ্রুপে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ওই ক্যাম্পে আক্রমণ চালাই। আমদের গ্রুপে ছিলাম গ্রুপ কমান্ডার আকতারুজ্জামান,শাজাহান ওরফে ছানা,জসিম উদ্দিন,শাজাহান আলীসহ ১১ জন। দুপুর পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। কিন্তু ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গুলি এসে আমার পেটের ডান দিকে বিদ্ধ হয়। আমি মাটিতে পড়ে যাই। পাকিস্তানিরা গুলি-গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। গ্রেনেডের কয়েকটি স্পিল্গন্টারও তখন শরীরে লাগে। সহযোদ্ধারা আমাকে রেখেই পিছু হটে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সূর্যের আলোতে সকাল ৮-৯টার দিকে জ্ঞান ফেরার পর পানি পানি বলে গোঙাচ্ছিলাম। এমন সময় একজন পাকিস্তানি এসে নৃশংসভাবে বেয়নেট চার্জ করে। দুপুরের পর পাকিস্তানিরা চলে গেলে গ্রামবাসীদের কয়েকজন আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যান। স্থানীয় একজন চিকিৎসক গুলি বের করে সেলাই দেন। অনেক কষ্ট হয়। তখনই জানলাম সহযোদ্ধা শাজাহান আলীর গলায় গুলি লেগেছে। আর শাজাহান ছানাসহ ১২-১৫ মুক্তিযোদ্ধা ধুলাউড়ি স্কুুলের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। পরদিন খবর এলো পাকিস্তানিরা আবারও গ্রামে এসে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছে,যারা আশ্রয় দিয়েছে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তখন আমি যে বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলাম তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আমাকে গ্রাম থেকে বের করে নিয়ে ৮-১০ ফুট লম্বা ছনের ক্ষেতে রেখে আসে। সেখানে শাজাহান আলীকেও আমার সঙ্গে রাখা হয়েছিল। সন্ধ্যার পরও গ্রামবাসী আমাদের নিতে আসেনি। শাজাহান আলী গোঙাচ্ছিল। কথা বলতে গেলে ঘড়ঘড় শব্দ হয় তার। আমরা তো ছিলাম আসলে মড়ার মতো। নড়তে চড়তেও পারতাম না। তখন আমাদের শব্দ পেয়ে দুটি শিয়াল আসে,ওরা শরীরে গন্ধ শোঁকে,গা চেটে দেয়। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টার পর শিয়ালগুলো চলে যায়। ৮-৯টার দিকে গ্রামবাসী এসে আবার তাদের বাড়িতে আমাদের নিয়ে যায়। পরে খবর পেয়ে আমার বাবা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য মাজেদুরকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং পরে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে রোমানিয়া পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফেরার পর তাকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরি দেওয়া হয়। তবে এরশাদের আমলের শেষ দিকে কল্যাণ ট্রাস্টের ওই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে মাজেদ পাবনার গ্রামের বাড়িতে আছেন। বর্তমানে সরকার থেকে পাওয়া যুদ্ধাহত ভাতার একটি অংশ স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫টি শিক্ষা বৃত্তি দেন তিনি। যাতে তার ব্যয় হয় বছরে ৫০ হাজার টাকা। মাঝে মাঝে স্কুলে স্কুলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণও করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক মাজেদুর রহমান বলেন,শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করতে শিক্ষাবৃত্তি চালু করেছেন। শারীরিকভাবে মাজেদুর রহমান এখন অনেকটাই অসুস্থ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পেট থেকে গুলি বের করতে গিয়ে বুক থেকে নাভি পর্যন্ত লম্বা সেলাই পড়েছে তার। মাঝে মাঝেই স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যান তিনি। তরুণদের কাছে প্রত্যাশা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে মাদক,সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবিরোধী মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে। অন্যায়ের দিকে যেন না যাও। দেশকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে এটি খুবই প্রয়োজন।